দীপ দেব ,আসাম:- আজ নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় সমিতি আসামের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও আসামের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে কাছাড়ের জেলাশাসক মারফত স্মারকপত্র প্রদান করে আসামে বসবাসকারী মানুষদের অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করা বন্ধ করতে ও বরাক উপত্যকার তিন জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা বন্ধ করতে জোরালো দাবি উত্থাপন করা হয়। জেলাশাসকের অনুপস্থিতিতে অতিরিক্ত উপায়ুক্ত সাধন সরকারের নিকট স্মারকপত্র তুলে দিয়ে সি আর পি সি সি, আসামের সভাপতি তথা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন যে গুয়াহাটি উচ্চ ন্যায়ালয় কেইস নং – পি আই এল ( সুয়ো মটো) / ৩/ ২০২১ সেকশন ৬ এ পরিস্কার ভাবে নির্দেশ দিয়েছে যে কোভিড মহামারির ফলে সৃষ্ট বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো ভাবেই কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না। কিন্তু আসাম সরকার উগ্র-প্রাদেশিকতাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর অন্যায় দাবি মেনে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করছে যা চূড়ান্ত অমানবিক। স্মারকপত্রে এও উল্লেখ করা হয় যে গত ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে দরং জেলার সিপাঝাড়ের ধলপুরে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে সাম্প্ৰদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রায় ১২০০ পরিবারকে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ করে। উচ্ছেদ হওয়া অঞ্চলের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য ৭ টি সরকারি এল পি স্কুল ছিল, এছাড়াও সেখানে বসবাসকারী ৭০ শতাংশ মানুষের রেশন কার্ড রয়েছে এবং অনেকের বাসগৃহ সরকারি প্রকল্পে তৈরি হয়েছে। অথচ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে অন্যায় ভাবে বলা হয়েছে যে অবৈধ বাংলাদেশীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। স্মারকপত্রে এও উল্লেখ করা হয় যে উচ্ছেদের প্রতিবাদে জনগণ কথা বললেই গুলি চালিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং ২৩ সেপ্টেম্বর তিনজন আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়েছে।
স্মারকপত্রে প্রধান মন্ত্রীর নিকট দাবি জানানো হয় যে যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের অবিলম্বে বাসস্থান নির্মাণের জন্য খাস জমি প্রদান করে পাট্টা বিলি করতে হবে, উচ্ছেদে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া জনগণকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অমানবিক ভাবে ভবিষ্যতে উচ্ছেদ করা চলবে না। এছাড়াও অপর একটি স্মারকপত্র রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিকট প্রদান করে দাবি জানানো হয় যে বরাক উপত্যকার তিন জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো অবস্থায় অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয় যে ১৯৬১, ১৯৭২ ও ১৯৮৬ সালে আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছেন বরাক উপত্যকার জনগণ। ১৯৬১ সালে সংঘটিত ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের চাপে আসাম সরকার ভাষা আইনে সংশোধন করে বরাক উপত্যকার তিন জেলার সরকারি স্কুলে ও কাজকর্মে বাংলা ভাষার প্রয়োগ অব্যাহত রাখে। সংগঠনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয় যে শহিদদের আত্মবলিদানে অর্জিত এই অধিকার কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত বরাক উপত্যকার জনগণ মেনে নেবে না, তাই প্রণবানন্দ রাজবংশীর মতো উগ্র-প্রাদেশিকতাবাদী মনোভাবাপন্ন বিধায়কদের ভবিষ্যতে বরাক উপত্যকার কোন সরকারি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে পাঠিয়ে এধরনের মন্তব্য না করাতে মুখ্যমন্ত্রীর নিকট দাবি জানানো হয়।
স্মারকপত্র প্রদানের পূর্বে জেলা শাসক কার্যালয়ের সামনে একটি বিক্ষোভ প্রদর্শন কালে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সংগঠনের কো – চেয়ারম্যান সাধন পুরকায়স্হ বলেন যে উগ্র-প্রাদেশিকতাবাদীদের মদতে পরিচালিত আসাম সরকার রাজ্যের ভাষিক সংখ্যালঘুদের সমস্ত ধরনের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। অথচ বরাক উপত্যকার শাসক দলের কিছু জনপ্রতিনিধি ও ভুঁইফোঁড় সংগঠনের পক্ষ থেকে উগ্র-প্রাদেশিকতাবাদীদের চক্রান্তের সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। যারা বরাক উপত্যকার জনগণের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অধিকার ও মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করছে। চরম সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিচালিত উগ্র-প্রাদেশিকতাবাদী শক্তির মদতে পরিচালিত এই সব সংগঠনের কথায় জনগণকে বিভ্রান্ত না হতে তিনি আহ্বান জানান। তিনি এও বলেন যে দুঃখের বিষয় হল এন আর সি ছুট নাগরিকদের আধার কার্ড কেন তৈরি হচ্ছে না বা তাদের ভবিষ্যত কী তা নিয়ে এসব সংগঠনের কোনও বক্তব্য নেই। বিক্ষোভ চলাকালে সেখানে উপস্থিত সি আর পি সি সি, আসামের অন্যতম কর্মকর্তা বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা নির্মল কুমার দাস বলেন যে ভবিষ্যতে রাজ্যের সমস্ত অনসমিয়া ভাষিক সংখ্যালঘু জনগণ উগ্র-প্রাদেশিকতাবাদীদের চক্রান্তে উচ্ছেদের শিকার হবেন, ব্রহ্ম কমিটির রিপোর্টে তা ইতিমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে।
যারা বর্তমানে রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদের সমর্থনে মিছিল করছেন ভবিষ্যতে তারাও ভোগান্তির শিকার হবেন এবং নাগরিকত্ব সহ জমির অধিকার হারাবেন। ‘ডি’- ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্প ও এন আর সি তালিকা তৈরির নামে রাজ্যের ভাষিক সংখ্যালঘুদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহানোর ইতিহাস জনগণ ভুলে যান নি। সংগঠনের সহ – সভাপতি সুব্রত চন্দ্র নাথ বলেন রাজ্যের গরীব মানুষকে উচ্ছেদ করে সে সব জমি বৃহৎ ব্যবসায়ী ও নেতা মন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছে। কর্পোরেটদের স্বার্থে পরিচালিত বর্তমান কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আগামীতে সবাইকে এগিয়ে আসতে তিনি আহ্বান জানান। আজকের স্মারকপত্র প্রদানে ও বিক্ষোভে সামিল হন বরাক ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ফ্রন্ট এর মুখ্য আহবায়ক কল্পার্ণব গুপ্ত, এস ইউ সি আই ( কমিউনিস্ট ) দলের জেলা সম্পাদক ভবতোষ চক্রবর্তী, আজমল হুসেন চৌধুরী, হিল্লোল ভট্টাচার্য, খাদেজা বেগম লস্কর, চাপ্মা লাল দাস, অঞ্জন কুমার চন্দ প্রমূখ।